খবরঃ
যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘অর্থের বিনিময়ে তথ্য গোপন’ করার মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হলেও, আদালত তাকে কোনও শাস্তি প্রদান করেনি। বিচারক রায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও, শাস্তির আওতায় না এনে তিনি নিঃশর্তভাবে খালাস পেয়েছেন। এর ফলে, ট্রাম্প কোনও সমস্যা ছাড়াই হোয়াইট হাউসে ফিরে যেতে পারবেন। শনিবার (১১ জানুয়ারি) আল জাজিরা ও ভয়েস অব আমেরিকা এর মতো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ৩৪টি গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল, যার মধ্যে প্রতিটি অভিযোগেই তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। নিউইয়র্কের ম্যানহাটান আদালতের বিচারক হুয়ান এম মার্চান জানিয়েছেন, ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্পকে চার বছরের কারাদণ্ড প্রদান করার সুযোগ থাকলেও তিনি সাংবিধানিক বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে মামলার পরিসমাপ্তি টানেন। বিচারক বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প যে আইনি সুরক্ষা পাবেন, তা অন্যান্য বিষয়কে ছাড়িয়ে গেছে। (https://www.dhakaprokash24.com/international/united-states-of-america/70509)
মন্তব্যঃ
একটি বিচার ব্যবস্থার কাজ যেখানে অপরাধীর শাস্তি কার্যকর করে তাকে অপরাধ থেকে বিরত (Deter) রাখা সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে গুরুতর অপরাধী অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে “শর্তহীন মুক্তি”ই প্রমাণ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থায় ‘সেপারেশন অফ পাওয়ার’, কিংবা ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ নামে যে সকল নীতি প্রচলিত রয়েছে তা বিত্তশালী, প্রতিপত্তি কিংবা ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। গণতান্ত্রিক আইনের মারপেঁচে শুধুমাত্র দরিদ্র কিংবা অসহায় ব্যক্তিরাই নিপতিত হয়। তাই কোনরকম অপরাধ না করা সত্ত্বেও ড. আফিয়া সিদ্দিকীকে মার্কিন আদালত ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। অথচ, জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন চলতি বছরের ১১ জুন অবৈধভাবে বন্দুক কেনা, কমপক্ষে ১.৪ মিলিয়ন ডলার ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার এবং মাদক গ্রহণ সম্পর্কে মিথ্যা বলার জন্য জন্য ফৌজদারি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলেও জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার Presidencial Power ব্যবহার করে ছেলে হান্টারকে পূর্ণ ও শর্তহীন ক্ষমা প্রদান করেছে (tbsnews, ২ ডিসেম্বর, ২০২৪)। আমাদের দেশেও আমরা দেখেছি, প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে টেক্স ফাঁকির মামলা থাকলেও তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার করে তা থেকে দায়মুক্তি নিয়েছেন। সম্ভাব্য ভবিষ্যত সরকারী দল বিবেচনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ অনেক নেতাকে মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে। হাসিনার শাসনামলে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফসহ বহু অপরাধীকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা ও বিচারিক দায়মুক্তি দিয়েছিল।
সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেহেতু মানুষকে “Legislative Power” দিয়ে থাকে, তাই ক্ষমতাধর এবং প্রতাপশালী ব্যক্তিদের দ্বারা বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে দায়মুক্তি নেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। কারণ, সেক্যুলার রাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যিনি অন্যদেরকে জবাবদিহিতা ছাড়াই ক্ষমা করতে পারেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই ধরনের দায়মুক্তি শাসকশ্রেণী, বিত্তশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদেরকে সীমাহীন অপরাধ এবং দুর্নীতিতে ব্যাপক উৎসাহ যোগায়।
অপরদিকে, ইসলামী ব্যবস্থায় আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তার, আর শাসকের দায়িত্ব শুধুমাত্র সেই আইন বাস্তবায়ন করা। ফলে, খিলাফত রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগ এবং বিচারবিভাগের মধ্যে প্রকৃত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি অন্যটির প্রভাব থেকে মুক্ত। ফলে, শাসকগোষ্ঠী কিংবা কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি অপরাধ করে তা থেকে দায়মুক্তি নেওয়ার সুযোগ থাকে না। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল খলিফা আলী (রা.)-(রা.)-এর ঘটনা। তিনি নিজের হারানো বর্ম এক ইহুদি ব্যবসায়ীর কাছে দেখতে পেয়ে বিষয়টি কাজি শুরাইহ'র আদালতে নিয়ে যান। বিচারক উভয় পক্ষকে সমান মর্যাদায় বসান। খলিফা যখন প্রমাণ হিসেবে তার পুত্র হাসান (রা.) ও ক্রীতদাস কানবারকে উপস্থিত করেন, বিচারক তা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, “পুত্রের সাক্ষ্য পিতার পক্ষে এবং ক্রীতদাসের সাক্ষ্য প্রভুর পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়।” তাই, প্রমাণের অভাবে তিনি ইহুদি ব্যক্তির পক্ষে রায় দেন। এই নিরপেক্ষ বিচার দেখে ইহুদি ব্যবসায়ী এতটাই মুগ্ধ হন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং স্বীকার করেন যে, বর্মটি সত্যিই খলিফার ছিল। খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় আরও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল যে, খলিফা কোন কাজির ইসলামসম্মত রায় বাতিল করতে পারতেন না। শারীরিক ক্ষতি, হত্যা, কিসাসসহ হুদুদ শাস্তি তিনি ক্ষমা করতে পারতেন না, কারণ ইসলামী শরীয়া তাকে সেই ক্ষমতা দেয়নি। এমনকি মাহকামাতুল মাযহালিম কোর্টে খলিফার বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন তিনি বিচারক অপসারণ করতে পারবেন না, যা সেক্যুলার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে অকল্পনীয়। “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, আল্লাহ্’র জন্য সাক্ষ্য প্রদানকারী হিসেবে - যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে অথবা পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। সে ধনী হোক বা দরিদ্র হোক, আল্লাহ্ উভয়ের অধিক হিতাকাঙ্ক্ষী। অতএব তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না যাতে তোমরা ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুত হও” (সূরা আন-নিসা: ১৩৫) ।
- আবি আব্দুল্লাহ